ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হিজবুল্লাহ: নাসরুল্লাহর মৃত্যু ও মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা
- By Jamini Roy --
- 16 October, 2024
২৮ সেপ্টেম্বরের দুপুরের পরই লেবাননজুড়ে থমথমে নীরবতা বিরাজ করছিল। ইরান–সমর্থিত সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার পর ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, কিন্তু সংগঠনটি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিল না। ইসরায়েল ওই দিন সকালেই নাসরুল্লাহর মৃত্যুর ঘোষণা দেয়। তবে বৈরুতের সদর দপ্তর থেকে নাসরুল্লাহর ভাগ্য বা হিজবুল্লাহর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো বিবৃতি আসেনি। দুপুর আড়াইটার দিকে হিজবুল্লাহ নিশ্চিত করে যে নাসরুল্লাহ ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের দাবি, এই হামলার মাধ্যমে তারা হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতাকে বিপর্যস্ত করেছে। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহর রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে। হিজবুল্লাহ তাত্ক্ষণিকভাবে ইসরায়েলের ওপর ১২টিরও বেশি রকেট নিক্ষেপ করে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু এতে কোনো বড় পরিবর্তন আসেনি। সংগঠনের ভেতরে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, এবং কীভাবে প্রতিশোধ নেওয়া হবে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই নাসরুল্লাহকে হত্যার পরিকল্পনা করছিল। ২০০৬ সালে তাঁকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, গত ১৮ বছরে ইসরায়েল একাধিকবার হামলার পরিকল্পনা করে। অবশেষে, ২৭ সেপ্টেম্বর নাসরুল্লাহ বৈরুতে হিজবুল্লাহর সদর দপ্তরে একটি গোপন আলোচনার জন্য আসেন, যা নিশ্চিত হওয়ার পর ইসরায়েল হামলা চালায়। এই হামলায় সংগঠনের সামরিক প্রধান ফুয়াদ শোকরসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতাও নিহত হন। এর পর থেকে ইসরায়েল লাগাতার হিজবুল্লাহর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।
নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর হিজবুল্লাহর সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে দুই নাম উঠে এসেছে: নাসরুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সহকারী নাইম কাশেম এবং নির্বাহী কাউন্সিলের সদস্য হাশেম সাফিউদ্দিন। ৭১ বছর বয়সী কাশেমকে নেতা হিসেবে মান্যতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠলেও, সাফিউদ্দিন কাশেমের চেয়ে কমপক্ষে ১০ বছরের ছোট এবং তিনি ইরানের ঘনিষ্ঠ। তবে সাফিউদ্দিনকে হত্যা করতেও হামলা করেছে ইসরায়েল।
হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের পরিবর্তনের সঙ্গে লেবানন ও সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইরান ইতিমধ্যে প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে এবং ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার হুমকি রয়েছে। হামাসের নেতাদের হত্যার পর ইরানের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে, এবং আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কা সত্যি হতে চলেছে।
ইরান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তবে ইরান এখন হিজবুল্লাহর দুর্বলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। হিজবুল্লাহ ছিল ইরানের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত মিত্র, এবং তাদের সামরিক সক্ষমতা ইরানের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করেছে।
আরব অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা ইসরায়েলের এই হামলাকে ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেসময় মিসরের ক্ষমতাশালী নেতা জামাল আবদেল নাসের ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। তেমনই, নাসরুল্লাহও ইরান সমর্থিত প্রতিরোধ বাহিনীর শক্তিশালী মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেছেন, কিন্তু ইসরায়েল কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁর সংগঠনের শক্তি ভেঙে দিচ্ছে।
তবে ইসরায়েলের পক্ষে হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয়। কারণ হিজবুল্লাহর কাছে হাজারো সশস্ত্র সদস্য এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াইয়ের পর সংগঠনের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব আগের হিজবুল্লাহর চেয়ে আলাদা হবে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, দ্য ইকোনমিস্ট ও এএফপি